ঘটনাটি ১৯৮৬ সালের। রাশিয়াতে চেরনোবিল পারমানবিক শক্তি কেন্দ্রে ঘটে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যু ঘটে বহু মানুষের। পাশাপাশি ধ্বংস হয়ে যায় সেখানকার গাছপালা , পশু-পাখি এবং অন্যান্য জীব। শুধু তাই নয়, আজ পর্যন্ত এর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে এলাকাটি কোনো জীব বসবাসের অযোগ্য। যাদের তৎক্ষনাত মৃত্যু ঘটে নি, তারাও সেখানকার চরম তেজস্ক্রিয় পরিবেশের প্রভাবে ক্যান্সার এবং অন্যান্য অস্বাভাবিক মিউটেশনের স্বীকার হয়। ইতিহাসের পাতায় এই দূর্ঘটনাটি চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয় হিসেবে পরিচিত। তবে এই বিপর্যয়ের মাত্র পাচ বছর পরে, ঠিক পারমাণবিক চুল্লীর ভেতরেই জীবনের সন্ধান মেলে। এরকম পরিবেশে জীবের সন্ধান পেয়ে তাক লেগে যায় সকলের। এই জীবটি কেবল যে চরম তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সহ্য করছিল তাই নয়, বেশ হাসি খুশি ভাবেই সেখানে বেড়ে উঠছিল। সেখানকার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তেজস্ক্রিয়া মুক্ত করার পাশাপাশি পুনরায় জীবের বেড়ে ওঠার জন্য এই জীব ক্রমাগত কাজ করে চলছে। জীবনের উপস্থিতি দেখে হতবাক বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে এই জীবের বহুমুখী সম্ভাব্য প্রয়োগক্ষেত্র খুজে পেয়েছেন।
Read this article in English: Chernobyl, Covid-19 and Black Fungus
১৯৮৬ সালের বিপর্যয়ের পর ১৯৯১ সালে মাত্র পাচ বছর পরে বিজ্ঞানীরা Cryptococcus neoformans নামে একটি ছত্রাক আবিষ্কার করেন পারমাণবিক চুল্লীর ধ্বংসস্তূপ থেকে। তবে ছত্রাকটি মানুষের কাছে নতুন ছিল না। ১৮০০ শতকের শেষ দিকে মানুষের শরীরে এলার্জি জাতীয় চর্মরোগের কারণ হিসেবে ছত্রাকটি বেশ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। এ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ধ্বংসাবশেষের আশেপাশে ৯৮ গণের প্রায় ২০০ প্রজাতির ছত্রাক আবিষ্কার করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল- Cladosporium sphaerospermum, Cryptococcus neoformans, Wangiella dermatitidis.
তারা কিভাবে বিকিরণ সহ্য করে
এই ছত্রাকের সাধারণের তুলনায় প্রায় ৫০০ গুণ বেশি বিকিরণ সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে। তেজস্ক্রিয় পরিবেশে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক বিকিরণের উপস্থিতিতে এ ক্ষমতা আরও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ছত্রাকগুলির হাইফি বিকিরণের উৎসকে কেন্দ্র করে বিস্তার লাভ করে। এ থেকে বোঝা যায় এটি মূলত সেই উৎস হতে খাদ্য গ্রহণ করছে। ক্ষতিগ্রস্থ হলে নিজেকে পুনরায় নিরাময় করবার ক্ষমতা রাখে এ ছত্রাক। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ খেকো এই ছত্রাকগুলো সাধারণত “কালো ছত্রাক/ ব্ল্যাক ফাংগাস” বা রেডিওট্রফিক ছত্রাক হিসেবে পরিচিত।
নাম “কালো ছত্রাক/ ব্ল্যাক ফাংগাস” কেন?
কালো ছত্রাক/ ব্ল্যাক ফাংগাস নামটি তাদের হাইফি তে উচ্চ মেলানিনের উপস্থিতির কারণে দেওয়া হয়েছে। এই সেই একই মেলানিন যার উপস্থিতি মানবত্বককে অতিবেগুনি রশ্মি হতে রক্ষা করে। অধিক পরিমাণে মেলানিনের উপস্থিতির কারণে এসব ছত্রাক কালো বা কালোর কাছাকাছি গাঢ় বর্ণের হয়ে থাকে। তাদের বর্ণই তাদের এরুপ নামের পেছনের মূল কারণ। মেলানিন গামা বিকিরণ শোষণ করে তাকে রাসায়নিক শক্তিতে রুপান্তরিত করে যা তাদের বৃদ্ধিতে সহয়তা করে। ঠিক যেমনভাবে গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ক্লোরোফিলের সহায়তায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে তাকে অক্সিজেন এবং গ্লুকোজে রুপান্তরিত করে। এটি কেবল মাত্র সালোকসংশ্লেষণেরই একটু ভিন্ন রুপ যাতে আলোর প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন তেজস্ক্রিয় বিকিরণের। প্রক্রিয়াটি রেডিওসিন্থেসিস নামি পরিচিত।
মেলানিন প্রয়োজনীয় বিকিরণ শোষণের পাশাপাশি ক্ষতিকর বিকিরণ হতেও ছত্রাকগুলোকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, দূর্ঘটনার জায়গা হতে সংগ্রহ করা ছত্রাকের দেহে একই প্রজাতির অন্য অঞ্চলের ছত্রাকের তুলনায় মেলানিনের উপস্থিতি বেশি। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ছত্রাকগুলো চুল্লীর ভেতরের ভয়ানক তেজস্ক্রিয় পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে, নিয়মিত বিকিরণের সংস্পর্শে আসা লোকদের ক্ষেত্রে ব্ল্যাক ফাংগাস এর ক্ষমতা ব্যবহার বেশ কার্যকরী হবে।
মহাকাশে কালো ছত্রাক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা
মহাজাগতিক বিকিরণে ছত্রাকটি কিভাবে মহাকাশ পরিবেশের সাথে লড়াই করে তা বুঝতে একটি স্পেসএক্স রকেট ২০১৬ সালে চেরনোবিল চুল্লী হতে আটটি প্রজাতির ছত্রাক নিয়ে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পাড়ি জমায়। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে ওজনহীন পরিবেশ এবং মহাজাগতিক বিকিরণ এই ছত্রাকের বিকাশকে প্রভাবিত করে সে ব্যাপারে জানা। কালো ছত্রাক কোনো সমস্যা ছাড়াই সেখানেও বিস্তার লাভ করতে থাকে এবং মহাকাশে টিকে থাকার মত একমাত্র জীব হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে জানুয়ারী ২০১৯ পর্যন্ত এক মাস জুড়ে আবারও এই ছত্রাকের উপর গবেষণা চালানো হয়। এইবারের গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল রেডিওট্রফিক ছত্রাকের ব্যবহার মহাজাগতিক বিকিরণের বিরুদ্ধে মহাকাশচারীদের সহায়তা করতে পারি কিনা তা দেখা। এই গবেষণাটি মঙ্গলগ্রহে সম্ভাব্য ভ্রমণের প্রচেষ্টার একটি অংশ ছিল।
এই পরীক্ষায় Cladosporium sphaerospermum ছত্রাকটি ব্যবহার হয়েছিল। ৩০ দিন ব্যাপী গবেষণায় বিজ্ঞানীরা খুবই চমকপ্রদ ফলাফল পেলেন। ছত্রাকটি যেখানে ব্যবহার করা হয়েছিল সেখানে বিকিরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। একটি ১.৭ মিমি পুরু মেলানিনবিশিষ্ট রেডিওট্রফিক Cladosporium sphaerospermum ব্যবহার করে পরীক্ষণ শেষে দেখা যায় বিকিরণের হার হ্রাস পেয়েছে ২.৪২%। যেখানে কোনো কালো ছত্রাক ব্যবহার হয়নি সেখানে মহাজাগতিক বিকিরণের পরিমাণ পাওয়া যায় ৫ গুণ বেশি। যদি কালো ছত্রাকের আবরণ দিয়ে কোনো জিনিসকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলা যায় তবে ধারণা করা যায় ৪.৩৪±০.৭% বিকিরণ প্রতিরোধ সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন, মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠে কালো ছত্রাকের একটি ২১ সেন্টিমিটারের পুরু আবরণ মঙ্গল পৃষ্ঠে মহাজাগতিক বিকিরণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে প্রতিহত করতে পারবে।
ব্ল্যাক ফাংগাসের ব্যবহার ক্ষেত্র
পৃথিবীতে কালো ছত্রাক তেজস্ক্রিয় পরিবেশকে তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত করবার হাতিয়ার হতে পারে। ফলস্বরুপ, কোথাও পারমাণবিক বিপর্যয় দেখা দিলে বা কোনো পরিবেশ তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়লে সেই পরিবেশটিকে আবার বাসযোগ্য করে তোলা যেতে পারে। রিকম্বিন্যান্ট ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা যদি কালো ছত্রাক থেকে মেলানিন বের করতে পারেন তবে সেটি সানস্ক্রিন তৈরির উপাদান হতে পারে। এতে করে ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আমরা সহজেই আত্মরক্ষা করতে পারি। সেই সাথে প্রতিহত করতে পারি ত্বকের ক্যান্সারের মত ভয়াবহ রোগসমূহকে। মহাশূণ্যে রেডিওট্রফিক এই ছত্রাকগুলো নভোচারীদের সুরক্ষার ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
ব্ল্যাক ফাংগাস এর ক্ষতিকর দিক
রেডিওট্রফিক ছত্রাকসমূহের প্রচুর উপকারীতা এবং সম্ভাব্য ব্যবহার ক্ষেত্র থাকার কারণে এটি বেশ গুরুত্ব বহন করে। তবে এটি উপকারের পাশাপাশি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। সুস্থ মানুষ যাদের প্রতিরক্ষা বা ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী তাদের এ ছত্রাক দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঘটনা বিরল। তবে এইডস রোগী এবং কোভিড-১৯ রোগীর মতো নিম্ন প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন রোগীরা বড় ঝুকিতে রয়েছেন। এই মুহূর্তে মহামারীর কালো ছায়ার কবলে পুরো বিশ্ব, প্রতিদিন মারা যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। তবে এটি যেন যথেষ্ট ছিল না। পরিস্থিতিকে আরও বিষিয়ে তুলতে যোগ হয় এসব ছত্রাকের আক্রমণ। সুবিধাবাদী আচরণের জন্য এই ছত্রাককে “সুবিধাবাদী প্যাথোজেন” বলা হয়।
ব্ল্যাক ফাংগাস মূলত ফুসফুসে সংক্রমণ তৈরি করে। এছাড়া এটি চামড়ায় ইনফেকশন জাতীয় রোগও সৃষ্টি করতে পারে। যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত দূর্বল সেক্ষেত্রে অবস্থা আরও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। তখন মেনিনজাইটিস এমনকি এনসেফালাইটিস হতে পারে। ব্ল্যাক ফাংগাসের কিছু প্রজাতি শ্বেত রক্তকণিকার ম্যাক্রোফেজে অন্তঃকোষীয়ভাবে জীবন বিস্তার করে। যেহেতু বহিরাগত এন্টিজেন বা আক্রমণকারী রোগজীবাণুকে মেরে ফেলতে ম্যাক্রোফেজ ই প্রধান ভূমিকা পালন করে তাই সব রকমের এন্টিফাংগাল ও এন্টিবায়োটিক ছত্রাক সনাক্তে ব্যর্থ হয়। এন্টিবায়োটিক কাজ না করার ফলে সেক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে।
পরিশেষে বলা যায়, রেডিওট্রফিক ছত্রাক/ কালো ছত্রাক প্রচুর সম্ভাবনাময় একটি জীব। ক্ষতিকারক বিকিরণ থেকে এটি যেমন আমাদের রক্ষা করতে পারে। তেমনি মহাকাশ ভ্রমণের ক্ষেত্রেও হতে পারে আমাদের রক্ষাকর্তা। এছাড়া মঙ্গল গ্রহে উপনিবেশ তৈরির স্বপ্নকে সত্যি করতে এর ভূমিকা হবে অনস্বীকার্য। তবুও, ব্ল্যাক ফাংগাস বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে ভয়াবহ মৃত্যুর দিকে। তাই আজ এটি একটি আতংকের নাম।
Very much informative. Loved it a lot 💙.
Thanks a lot for your feedback. <3
So much informative. I have liked it a lot and this article is portraying your hard work.
Thanks a lot. I’m glad you liked it. <3